কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় অভিযানে গিয়ে ডাকাতের হাতে সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজির সরওয়ার নির্ঝর খুনের ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় করেছে! এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ঘটনায় হার্ডলাইনে গেছে সেনাবাহিনী৷ ইতিমধ্যে হত্যাকান্ডের জড়িত নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা সবাই দুর্ধর্ষ ডাকাতদলের সদস্য বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
স্থানীয় ও প্রশাসনিক সূত্রও জানিয়েছে, সেনা সদস্য হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সবাই দুর্ধর্ষ ডাকাতদলের সদস্য এবং এই ডাকাতদলটি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনে ডাকাতি করে। এছাড়া স্থানীয় চিংড়ি প্রজেক্টসহ বিভিন্ন দিকে ডাকাতি করে।
স্থানীয় লোকজনসহ বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ডাকাতদলের সদস্যদের গড়ফাদার সাবেক এমপি জাফর আলম। এই দলের প্রধান স্থানীয় ডুলাহাজারার হেলাল। তবে এই ডাকাতদলকে ব্যবহার করে বেশ কয়েকজন মুখোধারী অপরাধী।
সেনা কর্মকর্তা হত্যার পর এই ডাকাতদলকে লালনকারীদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এর মধ্যে ঈদগাঁও বাজারের ইজারাদার রমজানুল আলমের নাম বেশ আলোচনায়। ওই ডাকাতদলের সর্দার হেলাল ও রমজানের গভীর সখ্যতার গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে!
অভিযোগ উঠেছে, ঈদগাঁও গরু বাজার কেন্দ্রিক চাঁদাবাজিতে জড়িত হেলালের নেতৃত্বাধীন ডুলাহাজারার ওই ডাকাত দল। এই চাঁদাবাজির মূল ভূমিকায় রয়েছেন ইজারাদার রমজান।
ঈদগাঁও গরুর হাটের বেচাকেনার সাথে জড়িত অনেকে জানিয়েছেন, পশু ক্রেতা-বিক্রেতার কাছ সরকারি নিয়ম মতে গরুপ্রতি বিক্রেতা ৭০০ ও ক্রেতা ৫০০ টাকা করে ১২০০ টাকা হাছিল নেয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে গরু-মহিষ কিনতে আসা ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে গরু বহনকারী প্রতি গাড়ি থেকে অবৈধভাবে ১১ হাজার ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে আসছে ইজারাদার রমজান।
এই বিষয়ে ইজারাদার রমজান গরু ব্যবসায়ীদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, ডাকাতমুক্ত হয়ে নিরাপদে গরু বহন করে নেয়ার জন্য চকরিয়া, খুটাখালী ও ডুলাহাজার ডাকাতদের দিতে এসব চাঁদা নেয় তিনি ও তার ম্যানেজার ফিরোজ।
গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে, ঈদগাঁও গরু বাজার ইজারা নিয়ে ডুলাহাজার দুর্ধর্ষ ডাকাতদল দিয়ে মহাসড়কে ডাকাতির ফাঁদ বসিয়েছে রমজান। এই ডাকাতদলের ভয় দেখিয়ে উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গরু কিনতে আসা ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে প্রতি গাড়ি থেকে সাড়ে ১১ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছে। এই টাকা থেকে ডাকাতদের জন্য অস্ত্র ও ডাকাতির নানা রসদ কিনেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো ব্যবসায়ী টাকা দিতে না চাইলে বা গড়িমসি করলে তাদের গরুবহনকারী গাড়িতে ডাকাত লাগিয়ে দেয়া হয়। চাঁদা না দেয়ায় ২০২২ সালের ৫ মার্চ ঈদগাঁও বাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাওয়ার পথে ডুলাহাজারা মালুমঘাট থেকে অস্ত্রধারী ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে গাড়িসহ গরুগুলো লুট করে। এই ঘটনায় গরুর মালিক রামুর আবু তাহেরের ম্যানেজার মোস্তাক বাদি হয়ে ইজারাদার রমজানকে প্রধান আসামী করে ডাকাতদের বিরুদ্ধে চকরিয়া থানা ডাকাতির মামলা করেছিলেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। উক্ত মামলার পর বহুদিন আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। পরে পরিস্থিতি হালকা হলে ফিরে এসে আবারো অবৈধ চাঁদাবাজি শুরু করেন।
রমজানের এই চাঁদাবাজি সিন্ডিকের সাথে এমপি জাফরের ডানহাত খ্যাত বাবলু, এমপির আরেক সহযোগী মিজান, রামুর সাদ্দাম জড়িত তথ্য রয়েছে।
আরো অভিযোগ রয়েছে, ডাকাতদলের সাথে এই চাঁদা থেকে ভাগ যায় হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশের কাছে! এই চাঁদা না দিলে পুলিশ দিয়েও গরুবোঝাই গরু আটক করায় ইজারাদার রমজান!
এই রমজান আলমের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অহরহ অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন। ২০২১ সালের ২৩ জুলাই কক্সবাজার শহরের কলাতলী ওয়ার্ল্ড বীচ রিসোর্ট থেকে রমজানকে ইয়াবাসহ আটক করেছিলো পুলিশ। ইজারাদারির আঁড়ালে সড়কে ডাকাতি, ইয়াবা ব্যবসা, চাঁদাবাজিতে তিনি জড়িত রয়েছেন ভুক্তভোগী ও স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, রমজানের অপরাধের খুঁটি হচ্ছে, সেনা কর্মকর্তা তানজির সরওয়ার নির্ঝর হত্যাকান্ডের প্রধান হোতা হেলালের নেতৃত্বাধীন ডাকাতদল৷ এই ডাকাতদলকে ব্যবহার করে সব অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটান রমজান। এমনকি সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে চোরাই গরু পাচার করতেও এই ডাকাতদলকে ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তের বেন্ডলা বাজার থেকে গর্জনিয়া-জোয়ারিয়ানালা-রশিদনগর হয়ে সরাসরি ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার বিনিময়ে রমজান নিজ দায়িত্বে ঈদগাঁও বাজারে বার্মিজ গরু আনেন। আর টাকা পাঠায় হুন্ডির মাধ্যমে। গর্জনিয়ার, শাকিল মেম্বার, সোহেল সিকদার ও দুর্ধর্ষ শাহীন ডাকাতের মাধ্যমে ঈদগাঁও গরুর বাজারে ঢুকানো হয়। এতে এই হাটটি বার্মিজ গরুর হাটে পরিণত হয়। একই সাথে ইয়াবা ও আইস আনার আনার তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে এমপি জাফরের পতন হলে চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী অবৈধ পশুর হাট গুড়িয়ে দিলে ডুলহাজারার বাবুল ও রমজান আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে বলে জানা গেছে!
জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকে ঈদগাঁ বাজারে শনিবার ও মঙ্গলবার গরুর হাট বসার নিয়ম থাকলেও নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে প্রধান সড়ক লাগোয়া পূর্বপাশে আনু মিয়া সিকদারের সিএনজি পাম্পের সাথে বিশাল বার্মিজ গরুর হাট বসিয়ে অবৈধ চাঁদাবাজি করছেন রমজান। এতে পাশে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ক্ষতি হচ্ছে।
অন্যদিকে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় রমজানের এই খামার থেকে বের হয়ে ফ্যাসিবাদীরা
আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে। তাই আন্দোলনকারীরা খামারটি বন্ধ করে দেয়। পরে পরিস্থিতি হালকা হলে আবার চালু করেছে। একই সাথে রাস্তার উপর গরু উঠানামা করায় গরু বেপারিরা ছাত্রীদের ইভটিজিং করে। এছাড়া শিক্ষার্থীসহ সবার চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
রমজানের লালিত ডুলাহাজারার হেলালের নেতৃত্বাধীন ডাকাতদলের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ বলে অনেকে জানিয়েছেন। সর্বশেষ এই ডাকাতদল ডুলাহাজারার এক প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতি করতে গেলে অভিযানে যায় সেনাবাহিনী। সেখানে তরুণ সেনা কর্মকর্তা তানজির সরওয়ার নির্ঝরকে নির্মমভাবে হত্যা করে এই ডাকাতদল!
কিছুদিন আগের এই ডাকাতদলের অধিকাংশ সদস্য কারাগার থেকে বের হয়েছে। তাদের ছাড়াতে প্রকাশ্যে দৌড়ঝাঁপ করেছেন দলের সর্দার হেলাল উদ্দীন। আর ঈদগাঁও বাজারের ইজারাদার রমজানসহ কয়েকজন জামিনের অর্থ যোগান দিয়ে বলে গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইজারাদার রমজানুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে তার ব্যবহৃত বন্ধ পাওয়া। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে এই মুহূর্তে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তা নিয়ে গভীর রহস্য তৈরি হয়েছে।
ঈদগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মছিউর রহমান বলেন, ‘আমি নতুন যোগ করায় এই সংক্রান্ত তথ্য এখনো পাইনি।’ তবে তিনি এই বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন, যৌথ অভিযানের জন্য নিয়মিত জেলা প্রশাসন, বিজিবি ও র্যাব পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা ছিল এবং থাকবে। চোরাই বা অবৈধ পণ্যের প্রতি আমাদের অভিযান সবসময় ছিল এবং থাকবে। তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসনের মাসোহারা বা আর্থিক লেনেদেনের বিষয়ে কেউ অভিযোগ দেয়নি। তারপরেও আমরা তদন্ত করে দেখব পুলিশ প্রশাসনের কোন ব্যাক্তি যদি জড়িত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে।