বান্দরবানের ঠিকাদারী ব্যবসা গুটিকয়েক ঠিকাদার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রন, প্রভাবিত করা ও ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া তাদের জন্য নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়াও প্রকল্পের কাজের অনিয়মতো আছেই। এগুলো দেখার যেন বান্দরবানে কেউ নাই। তাদের (ঠিকাদার সিন্ডিকেট) বিরুদ্ধে সাধারন ঠিকাদারেরা মুখ খুললে তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে কোণঠাসা করে দেয়া হয়।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া। এক কোটি দুই কোটি বা শত কোটি টাকা নয়। বিগত দুই যুগ ধরে প্রায় হাজার কোটি টাকার ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আসছে মুষ্টি কয়েক ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। শুধু উপজাতীয় লাইসেন্স ব্যবহার করেই এভাবে ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।
ফলে একদিকে সরকার হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব এবং অপরদিকে ব্যহত হচ্ছে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
তিন পার্বত্য জেলায় পিছিয়ে পড়া উপজাতিদেরকে ঠিকাদারী ব্যবসায় ভ্যাট ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে নমনিয়তা দেখিয়েছে সরকার। পার্বত্য অঞ্চলে কোন প্রকল্পের কাজ করলে সাধারন ঠিকাদারদের যেখানে ১১% ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয় সেখানে উপজাতিদের দিতে হয় মাত্র ৪ পার্সেন্ট। অর্থাৎ উপজাতিদের জন্য ৭% ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করেছে সরকার।
কিন্তু মুষ্টি কয়েক অসাধু ঠিকাদার সিন্ডিকেট এই সুযোগ ব্যবহার করে ৭% ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করছে নানান কৌশল। তাদের নিজেদের ঠিকাদারী লাইসেন্স ব্যবহার না করে ব্যবহার করছে উপজাতীয় ঠিকাদারী লাইসেন্সগুলো যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইউ.টি. মং, রতন সেন তঞ্চঙ্গ্যা, এম.এস মারমা, অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা, এম.এম ট্রেডার্স, মারমা এন্টারপ্রাইজ, ইমু কনস্ট্রাকশন, রিফ কনাস্ট্রাকশন, মিল্টন ট্রেডার্স এবং মায়াধন চাকমা।এটি শুধু বান্দরবানে নয়। সমান তালে এই লাইসেন্সগুলো পার্বত্য রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতেও ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়ে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর(এলজিইডি), বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে লাইসেন্সগুলো ব্যবহার হয়ে আসছে দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে।
সুত্রে জানা যায়, বিগত দুই যুগ ধরে বান্দরবানে প্রায় ১৫ হাজার ৩শ কোটি টাকার কাজ করেছে শুধু এই লাইসেন্স গুলোর নামে যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে প্রায় ৩ হাজার ১ শ কোটি, এলজিইডিতে প্রায় ৪ হাজার ৫ শ কোটি, পার্বত্য জেলা পরিষদে প্রায় ৩ হাজার ২ শ কোটি, সড়ক ও জনপদে ৩ হাজার কোটি এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রায় ১ হাজার ৫ শ কোটি টাকা।
সেই হিসেবে ৭% হারে মোট ১৫ হাজার ৩শ কোটি টাকার ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা।
বান্দরবান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. জিয়াউল ইসলাম বলেন, সরকার যদি ভ্যাট ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে পাহাড়ী বাঙ্গালী সবার জন্য নিয়ম সমান করে দেয় তাহলে সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। আর কেউ এভাবে ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারবেনা।
আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, উপজাতীয় লাইসেন্সগুলোর মালিকরা জানেনা কোন কাজ কোথায় হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে। তারা একটি কাজও তারা নিজ হাতে করেনি। শুধু তাদের কাজগপত্রগুলো ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছে দিয়ে দেয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর মাত্র ১ বা ২ পার্সেন্ট টাকা পায় লাইসেন্সের মালিকেরা।
এইসব অনিয়ম দীর্ঘ দুই যুগ ধরে করে আসছে মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন ঠিকাদার সিন্ডিকেট। শুধুভ্যাটট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই লাইসেন্স ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সুত্রে জানা গেছে, এই উপজাতীয় লাইসেন্সগুলোর মালিকেরা এমনকি স্বাক্ষর করা ব্লাঙ্ক চেক পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলার অসংখ্য ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছে জমা দিয়েছে যাতে তারা(ঠিকাদার সিন্ডিকেট) প্রকল্পের কাজ করে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে নিতে পারে।
কেন তারা কাজ না করে লাইসেন্সগুলো অন্যদেরকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে উপজাতীয় লাইসেন্সধারী রতন সেন তঞ্চঙ্গ্যাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রতিবেদকের বিকাশ নাম্বার খোঁজে।
লাইসেন্সধারী ইউ.টি. মং মিটিং এর ব্যস্ততা দিখিয়ে ফোন কেটে দেন।
আরো একটা বিষয় হচ্ছে, বান্দরবানে শতাধিত লাইসেন্স থাকলেও তাদেরকে কোন কাজ করতে দেওয়া হয়না। শুধুমাত্র ঠিকাদার সিন্ডিকেট সদস্যরাই কাজ পায় বাকী ঠিকাদারকে কোন কাজ দেওয়া হয়না।
বিষয়টি নিয়ে বান্দরবানে ঠিকাদারদের মধ্যে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন সাধারন ঠিকাদার বলেন, সিন্ডিকেটের বাহিরে বান্দরবানে কাজ পাওয়ার সুযোগ নাই। সিন্ডিকেটের সাথে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও জড়িত।
মোট কথা বান্দরবানে ঠিকাদারদের কার লাইসেন্স কে ব্যবহার করে বা কে কাজ করে কোন শৃঙ্খলা বলতেই নাই। কিন্তু এদিকে সরকার ঠিকই রাজস্ব হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে বান্দরবানের কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, সরকার যেখানে রাজস্ব বাড়ানোর চেস্টা করতেছে সেখানে বান্দরবানে ঠিকাদার সিন্ডিকেট হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েই যাচ্ছে। লাইসেন্সগুলো বাতিল করা উচিত অথবা উপজাতী ও বাঙ্গালীদের মধ্যে ভ্যাট ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে একই নিয়ম করা হলে সমস্যাটার সমাধান হবে বলে আশা করছি।