সোমবার- ২রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

dainiknilgiri.com

বনের ভেতর গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা পল্লী

বেদখল হচ্ছে চুনতি অভয়ারণ্য

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে লোহাগাড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায়  ১৯৮৬ সালে ৭হাজার ৭শত ৬৪ হেক্টর বনভূমি নিয়ে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষনা করা হয়। তার আগে এটি চুনতি রিজার্ভ বনভূমি নামেই পরিচিত ছিল।এটি এশিয়ান হাতির নিরাপদ করিডোর হিসেবে ওপরিচিত ছিল।

মুলত বনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র রক্ষা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষনের জন্যই চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।

এক সময় এখানে ছিল গগনচুম্বি গর্জন, বৈলাম, তৈলসুর কিংবা হাতি, চিতাবিড়াল,হরিন, উদবিড়াল আর বিচিত্র পাখি।

 বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্নে চলাফেরার সুবিধার্তে  অভয়ারণ্যে কোন বসতবাড়ি, খামার কিংবা চাষাবাদ করার নিয়ম না থাকলে ও এশীয়ান হাতির অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র চুনতি অভয়ারণ্য মানুষের দখলের কবলে পড়েছে। বনের প্রায় সাড়ে চার হাজার একর জমি দখল করে  অর্ধলক্ষ মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। ফলে এই বন থেকে বন্য প্রাণীরা সরে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে গড়ে ওঠা মানববসতি এভাবে বাড়তে থাকলে এই বন থেকে বন্য প্রাণীরা চিরতরে চলে যাবার আশংকা করছে পরিবেশবিদরা।

 অভয়ারণ্যের ভেতর গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাড়ীঘর, খামার, করা হচ্ছে চাষাবাদ। স্থানীয় লোকজন জানান, অভয়ারণ্যে চলছে জমি দখলের মহোৎসব। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয়  নেতা আর বনবিভাগের দায়িত্বশীল কর্তারা মিলে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বনের ভেতর শতশত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী পরিবারকে বসতবাড়ি নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে।তাই অভয়ারন্য আজ বন্যপ্রানীদের  পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের অভয়ারন্যে পরিণত হয়েছে। এতে কমে গেছে এশিয়ান হাতি সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর  বিচরণ, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হাতির প্রজনন।শুধু তাই নয় অনেক সময় হাতির স্বাভাবিক বিচরনে বাধাগ্রস্হ হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে ফসলি জমির ক্ষতিসহ মানুষের প্রাণহানীর ঘটনা ও ঘটেছে।

 সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,সবচেয়ে বেশি অবৈধ বসতি রয়েছে আজিজনগর, চুনতি ও হারবাং এলাকায়। সেখানে প্রায় ২হাজার পরিবার অবৈধভাবে বনের জায়গায় বসবাস করছে। যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা পরিবার।

 সম্প্রতি চুনতি রেন্জের আওতাধীন আজিজনগর বনবিট এলাকার পাশে গায়নাকাটা,কলাতলী,ডলুমনের গোদা নামক এলাকায় গিয়ে করুন দৃশ্য চোখে পড়েছে। প্রায় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারের বসতির কারনে বনের ভেতর  গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা পল্লী। স্হানীয়রা জানান, অভয়ারন্যের রাজা খ্যাত হারবাং ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারন সম্পাদক তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে এসব গড়ে উঠেছে।একেকটি পরিবারের কাছ থেকে ১থেকে ৫লক্ষ টাকা করে ও নিয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় লোকজন জানান, ১০-১৫ বছর আগে মানুষ কলাতলী এলাকায় গহিন অরণ্যের কারণে একা হেঁটে যেতে ভয় পেত।

একইভাবে, চুনতি বিটের গজালিয়া, খাঁচার পুকুর, পাগলীর গোদা, কুলপাগলী, রশিদার ঘোনা, ঢুলইন্যা, মুরংঘাটা ও বিট অফিসসংলগ্ন অভয়ারণ্যের অধিকাংশ জায়গা বেদখল হয়ে আছে।।এখানে রোহিঙ্গাদের বসতি স্হাপনে রাতের আধারে কেটে ফেলা হয়েছে শতবর্ষী শাল,গর্জন।

হারবাং বনবিটের আওতাধীন ভিলেজারপাড়া, ইছাছড়ি,গয়ালমারা,ভান্ডারীর ডেবা নতুনবাজার এখানে ও অভয়ারন্যের জায়গা দখল করে শতশত রোহিঙ্গা পরিবার বসতি স্হাপন করা হয়েছে।

 অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে স্হানীয় সরকারদলীয় কিছু নেতা ও বনবিভাগের একটি দালাল সিন্ডিকেইটের নেতৃত্বে ১৫-২০বছর ধরে চুনতি অভয়ারণ্যে জবরদখল চলছে।

তবে বনের কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দার,অভিযোগ সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ বসতি গড়ে ওঠার পেছনে অসাধু রেন্জ কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন  সরাসরি জড়িত।তিনি যোগদানের পর থেকে অভয়ারণ্যের গাছ বিক্রি ও রোহিঙ্গাদের পূর্নবাসনের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন বলে ও জানান তারা।

অভয়ারণ্যের চুনতি রেঞ্জ কর্মকর্তা  রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বনের জায়গা দখল করে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার  বাড়ি নির্মাণ করার কথা স্বীকার করে বলেন, এর জন্য স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা দায়ী। তবে কাঠ পাচারকারী ও অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের সখ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

চুনতি বন্য প্রাণী ও অভয়ারণ্যের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে চলা অবৈধ দখলের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি প্রশাসনের সহযোগিতায় এদের উচ্ছেদ করতে। টাকার বিনিময়ে অবৈধ দখলে সহায়তা ও গাছ কাটার প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভয়ারণ্যের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি আনোয়ার কামাল জানান, বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চুনতি অভয়ারণ্যের সাড়ে চার থেকে সাড়ে চার হাজার একর জায়গা জবরদখল হয়েছে এবং ঘরবাড়ি নির্মাণ চলছেই। গত  দুবছরে প্রায় এক হাজার একর জায়গা বেদখল হয়ে গেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, চুনতি অভয়ারণ্য আজ ক্ষতবিক্ষত। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের নামে অভয়ারন্যের বুক ছিড়ে পাহাড় কেটে চুনতি অভয়ারণ্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

17Shares

আরও পড়ুন

সম্পর্কিত আরো খবর

জনপ্রিয়